আর নয় ঝরেপড়া শিখব মোরা লেখা পড়া: মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
শিক্ষাকে প্রতিটি মানুষের জীবনকে একটি অমূল্য সম্পদ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এই শিক্ষাই আমাদের ভবিষ্যতের সমুহ সম্ভাবনাকে অনিশ্চয়তার কালোথাবা থেকে রক্ষা কবচ হিসাবে কাজ করে। একটি শিশু তার শিক্ষার সকল শক্তি দিয়ে জীবন পরিচালনার মানবীয় গুনাবলীকে অর্জন করতে সক্ষম হয়। তাই
আমরা অকপটেই বলে থাকি শিক্ষা মানব জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর প্রাথমিক শিক্ষাকে বলা হয় সকল শিক্ষার বুনিয়াদ। শিক্ষা ক্ষেত্রে আমাদের যেমন
সফলতা আছে তেমনি রয়েছে ব্যর্থতাও। বর্তমান সময়ে শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করা হলেও ঝরেপড়ার বিষয়টি আশঙ্কাজনক। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে প্রায় ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ৫ বছর মেয়াদি প্রাথমিক শিক্ষা চক্রে সমাপ্ত করতে পারছে না। এটি দেশের সকল শিক্ষা ব্যবস্থাকে ক্রমেক্রমে দূর্বল করে তুলছে।
তাহলে আসুন এবার আমরা জেনে নেই ঝরাপড়া কী? শিশুরা কেন ঝরে পড়ছে? ঝরাপড়া রোধে আমাদের কী করনীয়? প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গমন উপযোগী শিশুরা ১ম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ৫বছর মেয়াদী প্রাথমিক শিক্ষা চক্র শেষ হওয়ার পূর্বে মধ্যবর্তী যে কোন সময়ে যে কোন শ্রেণি থেকে যদি বিদ্যালয় ত্যাগ করে লেখা পড়া ছেড়ে দেয় বা শিশুশ্রমে নিয়োজিত হয়ে যায় তখন তাকে আমরা ঝরেপড়া বলে থাকি। এই ঝরে পড়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। ঝরেপড়ার সঠিক কারণগুলো চিহ্নিত করে অতিদ্রুত প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে অর্থাৎ ডিজিটাল যুগে এই শব্দটি আর মানানসই নয়। যে ভাবেই হউক ঝরে পড়ার শিকল ভেঙ্গে আমাদের শিশুদেরকে মুক্ত করে এই বিশ্বায়নের যুগে একজন মানবীয় গুনাবলী সম্পন্ন মানুষ রুপে প্রতিষ্ঠিত করার চেলেঞ্জ গ্রহন করতে হবে। তাহলে এবার জানা যাক শিক্ষার্থী ঝরা পড়া কারনগুলো।
যেমনঃ
১. অতি দারিদ্রতা
২. অভিভাবকের সচেতনতার অভাব
৩. শিক্ষার্থীদের শিশুশ্রমে জড়ানো
৪. বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অনিয়মিত উপস্থিতি
৫. শিশুরা অপুষ্টির শিকার হওয়া
৬. শিক্ষা বান্ধব শ্রেণিকক্ষ ও পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব
৭. বাল্য বিবাহ নিয়ে আইন প্রয়োগে দূর্বলতা
৮. পরীক্ষাভীতি ও অতিরিক্ত পড়াশোনার চাপ
৯. অভিভাবকের বাসস্থান পরিবর্তন
১০. বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দীর্ঘদিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকা
১১. বিদ্যালয়ের দূরত্ব ও প্রতিকুল প্রাকৃতিক পরিবেশ
১২. শিশুদের খেলাধুলার প্রতি বেশিআগ্রহ থাকা
১৩. পড়াশুনায় উদাশীনতা
১৪. সামাজিক নিরাপত্তার অভাব
১৫. গনিত ও ইংরেজি বিষয়ের প্রতি ভীতি কাজ করা
১৬. নিস্ক্রীয় এস এম সি ও পি টি এ
১৭. শিক্ষক অভিভাবক সম্পর্কের অবনতি
১৮. শ্রেনি উপযোগী যোগ্যতা অর্জনের পূর্ব প্রস্তুতি না নিয়ে পাঠদান করা
১৯. শিশুকে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেওয়া
২০. বিদ্যালয় পরিদর্শন জোরদার করা।
এছাড়াও অনেক কারণ রয়েছে। এই কারণগুলোই হলো প্রাথমিক শিক্ষার একটি বড় ব্যাধি। একটি শিশু ঝরে পড়া মানে হলো ওই সম্ভাবনাময় শিশুর জীবন দূর্বিসহ অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়া। তাই ঝরাপড়া রোধে আমাদের অনেক করনীয় রয়েছে। বর্তমান শিক্ষা বান্ধব সরকার দেশের সকল শিশুদের মাঝে শিক্ষাবর্ষের ১দিনেই বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করছেন। বিদ্যালয়গামী শিশুদেরকে শতভাগ উপবৃত্তি প্রদান করেছেন। শিশুরা যেন অপুষ্টিতে না ভোগে সেজন্য বিদ্যালয়ে দুপুরে খাবার হিসাবে মিড ডে মিল প্রথা চালু করছেন। শিশুদেরকে বিদ্যালয়ে ধরে রাখার জন্য প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি সুসজ্জিত মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ তৈরী করার নির্দেশনা রয়েছে। শিক্ষার্থীদের মাঝে পরীক্ষাভীতি দূরীকরণে নিজ বিদ্যালয়ে সকল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রস্তুতের নির্দেশনাও আছে । ঝরেপড়ার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে সেসব সমাধান করলে ইতিবাচক ফলাফল আশা করা যেতে পারে। তাছাড়াও ঝরে পড়া রোধে আমাদের অনেক করণীয় রয়েছে।
যেমনঃ
১. শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে অবহিতকরণ উঠান বৈঠক, মা সমাবেশ এবং অভিভাবক সমাবেশ করা।
২. দরিদ্র শিক্ষার্থীর পরিবারকে বিশেষ সহযোগিতা প্রদান করা
৩. শিশুরা যেন অপুষ্টির স্বীকার না হয় সেদিকে মায়েদের খেয়ালরাখা
৪. বিদ্যালয়ে শিশুবান্ধব ও সুসজ্জিত পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ তৈরী করা
৫. শিক্ষকদের নিয়মিত হোমভিজিট করা
৬. শিক্ষক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মাঝে নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা
৭. পরীক্ষভীতি দূরিকরণে পাক্ষিক ও মাসিক পরীক্ষাগুলো চালু রাখা
৮. শিশুদের খেলাধুলার সরজ্জাম পর্যাপ্ত পরিমানে বিদ্যালয়ে সংরক্ষন করা
৯. পড়াশুনায় মনোযোগ ফেরাতে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে এস আর এম বুক ও গল্পের বই পড়তে সুযোগ করে দেওয়া
১০. বিদ্যালয়ে আসা যাওয়ার সময়ে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে
১১. শিশুদের সকল প্রকার শাস্তির উর্ধে রেখে বন্ধু সুলভ আচরন করা
১২. শিশুর সৃজনশীল চিন্তা ও দক্ষতাকে গুরুত্ব দেওয়া
১৩. বিষয়ভীতি দূরীকরণে ফলপ্রসু ও কার্যকর পাঠদান করা
১৪. শ্রেণি কার্যক্রমে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের অভিভাবককে মোবাইল ফোনে অবগত করানো
১৫. প্রতি মাসে সেরা শিক্ষার্থী চিহ্নিত করে পুরষ্কৃত করা
১৬. বিদ্যালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রমে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেওয়া
১৭. নিয়মিত বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল গ্রহন করা
১৮. স্টুডেন্ট কাউন্সিল, ক্ষুদে ডাক্তার ও কাব শিশুদের সহায়তায় সহপাঠীদের বিদ্যালয়ে উপস্থিত নিশ্চিত করা যায়
১৯. দূর্বল শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে তাদের জন্য নিরাময় মুলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা
২০. বিদ্যালয়ের সহশিক্ষা কার্যক্রম জোরালো করা
২১. নিরক্ষর অভিভাবকদের চিহ্নিত করে তাদের সাথে শিক্ষার গুরুত্ব নিয়ে মতবিনিময় করা
২২. উপবৃত্তির পরিমান বৃদ্বি করে ৩০০টাকা করা
২৩. মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে ডীজিটাল পাঠদান নিয়মিতকরণ।
আলোচনান্তে আমি মনেকরি দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে প্রাথমিক শিক্ষার গুনগত ও পরিমানগত উন্নয়নের ধারাও অব্যাহর রাখা একান্ত জরুরী এবং ঝরেপড়া রোধে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রকে উপযুক্ত পলিসি তৈরী করে তা বাস্তবায়ন করা। উল্লেখিত পদক্ষেপ সমূহ যদি বাস্তবায়িত করা যায় তাহলে অনেকাংশেই ঝরে পড়া রোধ হবে বলে আমার বিশ্বাস।
লেখক- মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম
প্রধান শিক্ষক
আব্দুল্লাহপুর বাজার সরকারি প্রাথমিক
বিদ্যালয়,অষ্টগ্রাম, কিশোরগঞ্জ।