কিশোরগঞ্জ জেলা প্রথম করোনা ভাইরাসে (Covid-19) আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া করিমগঞ্জ উপজেলার কাদিরজঙ্গল ইউনিয়নের জঙ্গলবাড়ি গ্রামের সেলিম মিয়া(৪৫)র প্রতিবেশী বোন শাহনাজ হাসি’র দুঃখ ভারাক্লান্ত মনে কিছু কথা তার টাইমলাইন থেকে হুবহু তুলে ধরা হল:-
একজন সুস্থ-সবল মানুষের করোনার কাছে হেরে যাওয়া(সামাজিকতা বনাম অসামাজিকতা)
সেলিম মিয়া,বয়স ৪৫+। জেলাঃ কিশোরগঞ্জ, উপজেলাঃ করিমগঞ্জ, গ্রামঃ জঙ্গলবাড়ি। ঢাকার মানিকনগরে কসমেটিক্সের দোকান ছিলো।সারাদেশে গনপরিবহন বন্ধ হবার কারনে ২৪ তারিখ রাতে তিনি গ্রামের বাড়ি চলে আসেন।বাড়িতে এসে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছিলেন।রোজকার কাজ করা,মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া সবই ঠিক ছিলো।কিন্তু হঠাৎ সর্দিকাশি, জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।ভেবেছিলেন ঋতু পরিবর্তনের জন্য হয়ত এই অসুস্থতা।করোনা ভয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে চায়নি।কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না।
তার কাশির শব্দ এখনও কানে ভাসে।কি না কি মনে করে এজন্য প্রথম প্রথম কিছু বলিনি।কিন্তু কাশির পরিমান বৃদ্ধি পাওয়ায় গলা যখন ভেঙ্গে গেলো তখন প্রতিদিন চারবেলা গরম পানি খেতে ও লবন-পানির গড়গড়া করতে বলেছি।কিন্তু তখনও হয়ত অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিলো।
আজ নিজেকে খুব বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে।কেবল মনে হচ্ছে যদি আরও একটু বেশি গুরুত্ব দিয়ে ৩৩৩ তে কল করতাম তাহলে হয়ত আজ তিনি জীবিত থাকতেন।দেশে এখন ভ্যান্টিলেটরের কোন অভাব ছিলো না।চিকিৎসা পেলে হয়ত বেঁচে যেতেন।
সত্যিকার অর্থে প্রতিবেশী হয়ে প্রতিবেশীর দায়িত্ব পালন করতে পারিনি সামাজিকতার ভয়ে। কাশির শব্দ শুনেই শারীরিক ভাবে যে তিনি দুর্বল হয়ে যাচ্ছেন এটা বুঝা যাচ্ছিল।কিন্তু আমি যদি ৩৩৩ তে কল দিতাম আর ওরা যদি এসে রোগীকে নিয়ে যেতো তাহলে সামাজিক ভাবে আমারর পরিবার অসামাজিক হয়ে যেত।কিন্তু এই অসামাজিকতাই যে এখন সামাজিক আচরন তার সমাজের লোকজন এখনও মানতে চায় না।তাই অসামাজিক হওয়ার ভয়ে একটা তাজা প্রান করোনার কাছে হেরে গেলো।
তবে সামাজিকতার চিন্তাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে কল ঠিকই দেয়া হলো কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।৫/০৪/২০২০ তারিখ রাত ৩টার দিকেও উনার কাশির শব্দ শুনেছিলাম তবে শব্দটা অনেক ক্ষীণ ছিলো।হঠাৎ সকাল ৮ টার দিকে আমার ছোট ভাইটা ঘুম থেকে ডেকে বলে যে,সেলিম ভাই মারা গেছেন।৫ মিনিট মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিলো না।ছোটবোনটা ভয়ে কান্না শুরু করে দিলো।কারো মাথা কাজ করছিলো না।কারন তার উপসর্গ দেখে আমরা ১০০% নিশ্চিত ছিলাম এটা কোভিড-১৯।কিন্তু এতোটা গুরুতর বুঝতে পারিনি।
আবেগ নিয়ন্ত্রন করে ছোটভাইটা করিমগঞ্জ থানা এবং কিশোরগঞ্জে রোগীর সেম্পল নেয়ার জন্য কল দেয়।কারন একজন মারা গেছে তার পরিবারের অন্যদেরকে তো বাঁচাতে হবে,গ্রামকেও সতর্ক করতে হবে।কিন্তু এতেও বাদ সাধলো সামাজিকতা।আর এই সামাজিকতার ভয়ে ব্যক্তির পরিবার ও গ্রাম্য ডাক্তার করোনা বিষয়টা ধামাচাপা দিতে বলে যে, তিনি নাকি ডাইবেটিকস লো হয়ে মারা গেছেন।পুলিশও তাদের কথা শুনে গ্রামের মানুষকে বললেন তিনি অন্য কারনে মারা গেছেন।পুলিশের কথা শুনে গ্রামের মানুষ দল বেধে মৃত ব্যক্তিকে দেখতে আসেন।স্বাভাবিক মৃত্যুর মতই সব কাজ সম্পূর্ন হয়।
আর এদিকে থানায় জানানোর জন্য আমাদেরকে অসামাজিক অপবাদও শুনতে হলো।।
শেষে অনেক জলপনা কল্পনার পর মৃত ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করা হয়।আর আজ ৭/০৪/২০২০ রাত ১১ টায় কিশোরগঞ্জ সিভিল সার্জন অফিস থেকে নিশ্চিত করা হয় তিনি কোভিড -১৯ এ আক্রান্ত ছিলেন।
গ্রাম্য ডাক্তারের কারনে আজ হয়ত আমাদের গ্রামের অনেকেই এই মরননাশী করোনায় আক্রান্ত হলেন।এর দায় কে নিবে??
বেশি সামাজিকতা দেখানোর কারনে গোটা সমাজ আজ ভীত।হয়ত আক্রান্তও।
প্রায় সবটা বিষয় লিখার কারন হলো,লোক দেখানো সামাজিকতার জন্য আর যেনো কোন তরতাজা প্রান করোনার কাছে হেরে না যায়।কেউ যেনো ডাক্তার দেখাতে ভয় না পায়।আর যেন এতো ঢালাও ভাবে গ্রামের মানুষ আক্রান্ত না হয়।আর যেন কারো কথায় পুলিশ কোন সিদ্ধান্ত না দেয়।
এখন যতটা পারা যায় অসামাজিক হয়েই পরিবার,প্রতিবেশী, সমাজ তথা দেশকে রক্ষা করতে হবে।তবে সমাজে করোনা আক্রান্ত পরিবারের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্যগুলোর যথাযথ পালন করতে হবে।