১১ তারিখ শনিবার। ভোরের আলো সাহিত্য আসরের ৭০০তম আসর। এ সভাটি নির্ধারণ করা হয়েছে হাওরের জলরাশিতে।
শুক্রবার সন্ধ্যা থেকেই শহর সহ আশেপাশের থানাগুলোতে বিদ্যুৎ নেই। গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ। রাত প্রায় এগারোটার দিকে বাইক নিয়ে বের হলাম একটু প্রশান্তির আশায়। বাইক নিয়ে চলে গেলাম শহরের বাহিরে আগে থেকে বসে থাকা বন্ধুদের আড্ডায়। ব্যাস শুরু হলো আড্ডা! কিছুক্ষণ পরই প্রশান্তির বার্তা নিয়ে চলে আসলো মুশলধারে বৃষ্টি। গরমকে যেন মূহুর্তেই তাড়িয়ে দিল জনজীবন থেকে। ফোনে জানতে পেলাম বিদ্যুৎ এসেছে তখন প্রায় পৌনে দুইটা বাজে।
ট্রলারের ছাদে ভোরের আলো সাহিত্য আসরের সভাসদবৃন্দ
কিন্তু বিধিবাম, বিদ্যুৎ তো থামছেই না সাথে আবার বজ্রপাতের ভয়ানক শব্দ। কি আর করা বৃষ্টি থামার অপেক্ষা। রাত প্রায় তিনটা বাজে বাসায় পৌছলাম।
ঘুম কখন আসছে জানিনা, ৫টা ৩৭ মিনিটে মোবাইলের ক্রিংক্রিং শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। কল রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে শুনা যাচ্ছে, ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে চলে আসো ভোরের আলো সাহিত্য আসরের কার্যালয়ে আর সেখান থেকেই আমরা রওনা হব। একদমে সব কথা শেষ করে আমার জ্বি উত্তর পেয়ে ফোন কেটে দিল। বুঝতে বাকি রইল না ভোরের আলো সাহিত্য আসরের প্রতিষ্ঠাতা রেজাউল হাবিব রেজা ভাইয়ের ফোন কল।
সূর্য মামা পূর্ব গগনে উদয় হচ্ছে দিনের বার্তা নিয়ে।আমরা যথা সময়ে কিশোরগঞ্জ আসরের অস্থায়ী কার্যালয় থেকে সিএনজি চালিত অটো রিক্সা দিয়ে রওনা হলাম হাওরের প্রবেশদ্বার বালিকলার উদ্দেশ্যে। করিমগঞ্জ পৌছার আগেই সংবাদকর্মী শফিক কবির কল করেন আমাদের সহকর্মী হাবিবুর রহমান বিপ্লবের কাছে এবং তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে রাস্তায় দাঁড়ানোর জন্য। সমিতি বাজার থেকে তাকে পিক আপ করার জন্য সিএনজি দাঁড় করা হয়। সহকর্মীর চা আপ্যায়ন এর মাঝে রেজাউল হাবিব রেজা ভাইয়ের ধমকের চয়নে তাড়াতাড়ি আবার রওনা দিলাম প্রবেশদ্বার উদ্দেশ্যে।
বালিখলা পৌছে আমরা আগে থেকে প্রস্তুত রাখা ইঞ্জিন চালিত ট্রলার দেখতে পেলাম। আমরা প্রায় ৫০ জনের মত সবাই একত্রিত হয়ে ট্রলারে উঠে গেলাম। প্রতিষ্ঠাতা এবং সভাসদগণের পূর্ব নির্ধারিত আলোচনায় রওনা দিলাম রাতারগুল মানে নিকলী উপজেলার ছাতিরচর করস বনের উদ্দেশ্যে। ট্রলার চলতে থাকলো ভট ভট শব্দে আর আমরা মেতে উঠলাম শিল্পী মাজহারুল ইসলামের গানে, কবিতা, কৌতুকের ছন্দে।হাওরে পাশাপাশি চলা যাত্রীবাহী ট্রলার, মাল বোঝাই কার্গো, আবার কোথাও জেলে নৌকার মাছ ধরার দৃশ্য, আকাশে পাখির উড়াউড়ি, ছো মেরে শিকারী পাখির মাছ ধরা। আর পানির ওপর ভেসে থাকা ছোট ছোট গ্রাম, আবুরা সড়ক, মাঝে মাঝে দৃষ্টিনন্দন সেতু।
প্রকৃতির সৌন্দর্যের পাশাপাশি কৃত্রিম আনন্দ যেন একাকার হয়ে হারিয়ে গেলাম এক অনাবিল আনন্দে। এর মাঝে শাসনের বাক্য ভেসে এলো আমাদের কানে। ভোরের আলো সাহিত্য আসররের প্রতিষ্ঠাতা রেজাউল হাবিব রেজা, সভাপতি নাট্যকার আজিজুর রহমান, প্রধান পৃষ্ঠপোষক বীর মুক্তিযোদ্ধা নিজাম উদ্দিন, প্রধান উপদেষ্টা হাফিজুর রহমান, উপদেষ্টা হীরা মিয়া, বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মতিন আকন্দ, জাহাঙ্গীর কবীর, আলী আকবর খান বাচ্চু, মিরাশ উদ্দিন ফকিরসহ আরও অনেকের শাসন বাক্য ব্যয়।
হাওরের বুক ছিড়ে ট্রলার চলছে ছাতিরচর করসবনে দিকে। কিছু দূর যেতেই আসরের উপদেষ্টা হীরা ভাইয়ের শশা আপ্যায়ন। শশা খেতে খেতেই দূর থেকে করসবন দেখে মনের অজান্তেই এক আনন্দ ছুঁয়ে গেল। আমার প্রস্তুত হতে দেরি হল না কারণ আগে থেকেই প্যান্ট ব্যাগে বন্দি ছিল আর আমি ছিলাম লুঙ্গি পরিহিত বাঙালির সাজে। করসবনের কাছাকাছি এসেই গায়ের টি শার্টটি খুলে প্রথমেই ঝাপিয়ে পরলাম করস বনে থৈ থৈ পানির মাঝে। আমাকে দেখে সংবাদ কর্মী শফিক কবির, হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক মোবারক হোসেন খান, সংবাদকর্মী ফরহাদ হোসেন, সমাজ সেবক শাহিনুর রহমান সহ আরও অনেকেই। পানির আনন্দ উপভোগ করতে ভুল করেননি কবি সানজিদা ঊষা। করস বনের উচ্ছ্বাসের ইতি টানেন বেধে দেয়া সময় এবং রেকাউল হাবিব রেজা ভাইয়ের ডাকে।
করসবন, ছাতিরচর, নিকলী
মন খারাপ করে ট্রলারে উঠে আবার আনন্দে মেতে উঠলাম গানের ছন্দে। উদ্দেশ্যে এবার মিঠামইন প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট। হাওরের বুক ছিড়ে সেই পুরনো ভট ভট শব্দে এবং গানে চলছে আমাদের ট্রলার ধনু নদীর মাঝ দিয়ে। একদিকে প্রচন্ড রোদ্রের খরতাপ আরেক দিকে হাওরের জলরাশি আলিঙ্গণ করে আসা বাতাস খারাপ লাগছে না হয়তো কারোর।
দূর থেকে দেখা যাচ্ছে আকাঙ্ক্ষিত প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট। আর এদিকে ভোরের আলো সাহিত্য আসরের অন্যতম উপদেষ্টা করিমগঞ্জের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলী আকবর খান বাচ্চু ভাইয়ের ক্ষিধে মিটানোর প্যাকেট খুলে খেতে খেতে চোখে ভেসে উঠলো কাঙ্খিত গন্তব্য। যারা আগে সেখানে যায়নি তাদের মনে প্রস্ফুটিত হচ্ছে আলাদা আনন্দ। অপেক্ষার প্রহর শেষ করে চলে এলাম কাঙ্খিত গন্তব্যে। এক এক করে সবাই ট্রলার ত্যাগ করে প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট এর অভ্যর্থনা কক্ষের সামনে শুরু হল গ্রুপ ছবি এবং সেল্ফি তুলার কাজ। প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট এর কর্মীদের দেয়া দিক নির্দেশনায় ঘুরে দেখে এসেছি প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট। আমার কাছে প্রখর রোদে ভালো না লাগলেও ভ্রমণ পিপাসু পর্যটকদের ভীড় ছিল চোখে পড়ার মত। রিসোর্ট ত্যাগ করার মোটামুটি সবারই তাড়া লক্ষ করলাম। তাই আমিও দেরি না করে সবার সাথে আবার উঠে পড়লাম ট্রলারে। এবার গন্তব্য মহামান্য রাস্ট্রপতির বাড়ি।
আবার চলল ট্রলার; অল ওয়েদার রাস্তায় নির্মিত সেতুর নিচ দিয়ে চলে আসলাম কামালপুর শান্তিপুর ঘাটে। তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া শুরু করছে।ট্রলার থেকে নেমে অনেকেই চলে গেল কামালপুর মহামান্য রাষ্ট্রপতির বাড়ি দেখতে। আমি ট্রলারে ছিলাম এবং ফোন করলাম বন্ধু সারোয়ারের কাছে। বাড়িতে খুব তাড়াতাড়ি চলে আসলো সে। তার সাথে আনা ছোট্ট একটি ছাতার নিচে দাঁড়িয়ে ৬/৭ জন কুশল বিনিময় শুরু করলাম। বন্ধু অনেক আপ্যায়ন করালো এবং আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিল। আমরা আবার রওনা দিলাম বালিখলার উদ্দেশ্যে।
বালিখলা পৌঁছে ছোট ভাই সহকর্মী মামুনুর রশীদের বাইকে চড়ে কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে।সূর্য এখন গোধূলিলগ্নে। উদ্দেশ্য এখন নিজ গৃহ। বাসায় পৌঁছে গোসল করে কাপড় কিনে নিলাম এবং বিছানায় শরীর হেলানোর পর কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বলতেই পারবো না। সকালে ঘুম ভাঙ্গার পর মনে হলো ভোরের আলো সাহিত্য আসরের ৭০০তম দিন দিনটি ছিল একটি স্বপ্ন যদিও বাস্তব ছিল।
এভাবেই যেন যুগ যুগ চলতে থাকে ভোরের আলো সাহিত্য আসর।
আলী রেজা সুমন
প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক
ভোরের আলো সাহিত্য আসর,
সম্পাদক, newsmonitor24.com