এজি লাভলু, কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি: সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পারিবারিক সিদ্ধান্তে বিয়ে হয় কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ব্রহ্মত্তর গ্রামের হাজেরা বেগমের। বিয়ের দুই বছরের মাথায় যমজ সন্তানের জন্ম দেয় সে। হাজেরার বয়স এখন ১৬ আর তার যমজ মেয়েদের বয়স ২২ মাস।
১২ বছর বয়সে বিয়ে হয় লিপির। ১৫ বছরের লিপির কোলে এখন ২২ মাসের শিশু সন্তান। শিশু বয়সেই মা হয়েছে ওই গ্রামের আঁখি, শাহীনা আক্তারসহ অনেক শিশু-কিশোরী, যাদের সবার বয়স আঠারোর নিচে।
সহপাঠীদের সঙ্গে খেলাধুলা আর স্কুলে গিয়ে পড়ালেখার বয়সে শুধু সংসারের ঘানিই নয়; তারা এখন সন্তানের মা হয়ে মাতৃত্বের ভারও বহন করছে। এমন চিত্র কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নসহ প্রায় পুরো জেলায়। বাল্যবিয়ে এখানে যেন স্বাভাবিক নিয়ম! যদিও প্রশাসনের দাবি, অনলাইনে জন্ম নিবন্ধন ও বয়স যাচাই করে বিয়ে রেজিস্ট্রি করার বাধ্যবাধকতা থাকায়; এ জেলায় বাল্যবিয়ের হার অনেকাংশে কমে আসছে। আর সমাজকর্মীদের তথ্য মতে, ওই ইউনিয়নে এখনও প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ ভাগ শিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে থাকে।
গত ২৫ নভেম্বর ২০১৯ ইং তারিখে ঘোগাদহে সরকারি তালিকাভুক্ত সুবিধাভোগীদের একটি বৈঠকে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে উপস্থিত বেশির ভাগ প্রসূতি মা-ই বাল্য বিয়ের শিকার এবং তারা সবাই শিশু বয়সেই সন্তানের মা হয়েছেন।
বাল্যবিয়ে নিয়ে কাজ করেন এনজিও কর্মী আতিকুর রহমান। তিনি জানান, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এবং দারিদ্র্যের কারণে এই ইউনিয়নে এখনও অহরহ বাল্য বিয়ে হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে সচেতন মানুষের উপস্থিতিতে এসব বিয়ে হলেও বেশির ভাগ হচ্ছে গোপনে।
অনলাইনে বয়স যাচাইসহ বিবাহ নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও কীভাবে বাল্যবিয়ে হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে আতিকুর বলেন, কাজিদের কাছে নিবন্ধন বইয়ের বিকল্প বই থাকে। তারা বয়স উল্লেখ না করে বর ও কনের যাবতীয় তথ্য সেখানে লিপিবদ্ধ করেন। পরে বর ও কনের নির্ধারিত বয়স পূর্ণ হলে কাজিরা এসব তথ্য মূল ভলিয়মে নিবন্ধন করেন। আর বিয়ের বৈধতা দেওয়ার জন্য কাজিরাই শরিয়া আইন অনুযায়ী ধর্মীয় রীতিতে বিবাহ সম্পন্ন করান।
সামাজিক সংগঠন ‘ছায়া’র সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম বলেন, ঘোগাদহ ইউনিয়নে বাল্যবিয়ের হার প্রায় ৫০ ভাগ। আমরা প্রথম দিকে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে কাজ করে অনেকটা ব্যর্থ হয়েছি। এখন বাল্যবিয়ের কুফল নিয়ে সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর কাজ করছি। এতে সফলতা পাওয়া যাচ্ছে। ফলে বিগত কয়েক বছরে বাল্যবিয়ের হার ৭০ ভাগ থেকে কমে এখন ৫০ ভাগে এসেছে।
তিনি জানান, বাল্যবিয়ের শিকার এসব মেয়ে অল্প বয়সেই মা হচ্ছে এবং অপুষ্টিতে ভুগছে।
গত ২৪ নভেম্বর রাতে শাহনাজ পারভীন নামে দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর বাল্যবিয়ের ঘটনা জানিয়ে খোরশেদ বলেন, গভীর রাতে গোপনে এসব বিয়ে হয়ে থাকে।পরের দিন আমরা খবর পাই। তখন আর তেমন কিছু করার থাকে না।
ঘোগাদহ ইউনিয়নে বাল্যবিয়ের প্রবণতার কারণ সম্পর্কে অনুসন্ধানে জানা যায়, দারিদ্র্য, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এবং মেয়ের বয়সের সঙ্গে যৌতুকের আপেক্ষিক হার বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণ। এছাড়া, শিশু বয়সেই প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে যাওয়ায় অনেক অভিভাবক মানসম্মানের ভয়ে কন্যাশিশুদের আগেভাগেই বিয়ে দিয়ে দেন।
জমিলা বেগম নামে এক অভিভাবক জানান, তার দশম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েকে তিনি বছরখানেক আগে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের কোলে এখন দেড় মাস বয়সী সন্তান আছে।
জমিলার ভাষ্য, মেয়ে একটু বড় হলে বিভিন্ন ঘর থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে। তখন বিয়ে না দিলে যদি কোনও অঘটন ঘটে যায়, সেই ভয়ে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। কম বয়সে বিয়ে দিলে যৌতুকও কম দেওয়া লাগে।
ঘোগাদহ ইউনিয়নের বাসিন্দা মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, ওই ইউনিয়নে বেশির ভাগ বাল্যবিয়ে হচ্ছে- অশিক্ষিত কিংবা অল্প শিক্ষিত দরিদ্র পরিবারগুলোতে। সাবালক হলে বেশি যৌতুক দিতে হয়, এজন্য নাবালক অবস্থায় তারা মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়। ফলে অপরিণত বয়সে সন্তানের মা হচ্ছে এই শিশুরা।
ঘোগাদহ ইউনিয়নে বাল্যবিয়ের প্রবণতা সম্পর্কে জানতে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শাহ আলমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
তবে বাল্যবিয়ে অব্যাহত থাকার বিষয়টি স্বীকার করে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিলুফা ইয়াছমিন বলেন, বাল্যবিয়ে এবং অপরিণত বয়সে মা হওয়ার খবর আমরা প্রায়ই পাচ্ছি। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিসহ প্রশাসনিক সব প্রচেষ্টা আমরা অব্যাহত রেখেছি। অনেক ক্ষেত্রে গোপনে এবং এলাকার বাইরে গিয়ে বাল্যবিয়ের ঘটনা ঘটছে। এক্ষেত্রে আমরা দুর্বলতার জায়গাগুলো চিহ্নিত করার কাজ করছি এবং সে অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাবর প্রস্তাবনা পাঠিয়ে থাকি। তবে বাল্যবিয়ের হার দিন দিন কমে আসছে বলে জানান তিনি।